বিজ্ঞানী আল বিরুনী


বিজ্ঞানী আল বিরুনী

full_279472847_1445563985

প্রাচ্যের বিজ্ঞানীদের জীবন আলোচনা করার সময় প্রসঙ্গত একজনের নাম চলে আসে। গণিতবিদ্যায়
যার অবদান উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানের প্রায় সবকটি শাখায় তিনি গবেষণা করেছেন।
সেই সঙ্গে তাঁর মূল্যবান মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি হচ্ছেন আবু রৈহান
মুহম্মদ ইবন আহমদ আল বিরুনী। আল বিরুনী নামে তিনি অধিক পরিচিত।

বিজ্ঞানীর জীবনে অবিস্মরণীয় ঘটনা
আল বিরুনী ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি
সর্বপ্রথম প্রাচ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশেষ ক’রে ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের
প্রতি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অধ্যাপক মাপা এর
মতে, “আল বিরুনী শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের
শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তিদের এক জন।”
একদিনের ঘটনা। সুলতান মাহমুদ গজনিতে তার মনোরম বাগানে গ্রীষ্মবাসের ছাদে
বসে আল বিরুনীকে বললেন, এ বাড়ির চার দরজার কোন্ দরজাটি দিয়ে আমি বের হবো,
আপনি তা গননা করে একটি কাগজ়ে লিখে আমার কম্বলের নিচে রেখে দিন। আল-বিরুনী
তার আস্তারলব যন্ত্রের সাহায্যে অঙ্ক কষে নিজস্ব মতামত একটি কাগজ়ে লিখে
সুলতান মাহমুদের কম্বলের নিচে রেখে দিলেন। তখন সুলতান রাজমিস্ত্রির
সাহায্যে একটি নতুন দরজা তৈরি করে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে দেখেন আল
বিরুনীর কাগজে যা লেখা ঠিক তারই অনুরূপ, “আপনি পূর্ব দিকের দেয়াল কেটে
একটি নতুন দরজা তৈরি করে বেরিয়ে যাবেন”। কাগজের সেই লেখা পড়ে সুলতান ভীষণ
রাগান্বিত হয়ে ছাদ থেকে আল বিরুনীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য
আদেশ দিলেন। কিন্তু মশামাছি রক্ষা পাবার জন্য নিচে জাল দেওয়া ছিল। সুলতানের
আদেশ কার্যকর হওয়ার ফলে আল বিরুনী সেই জালে আটকে যাওয়ায় তেমন আঘাত পেলেন
না। সুলতান আল বিরুনীকে আবার ডেকে আনলেন। সেই সঙ্গে তার চাকরের মাধ্যমে আল
বিরুনীর দৈনিক ভাগ্য গণনার ডায়েরিটা নিয়ে সুলতান দেখলেন, তাতে লিখা আছে
“আমি আজ উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে গেলেও বিশেষ আঘাত পাব না”। এ দেখে
সুলতান আরো রেগে গিয়ে আল বিরুনীকে জেলে পাঠালেন। কিন্তু কেউ এর পরে আল
বিরুনীকে কারগার থেকে মুক্তির সুপারিশ করতে সাহস পেলেন না। ঠিক ছয় মাস পরে
সুলতানের মন মেজাজ বুঝে প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাসান একদিন আল বিরুনীর প্রতি
সুলতানের নেক নজর আকর্ষণ করলেন। সুলতান মাহমুদের এ কথা স্বরণই ছিল না। ফলে
সুলতান তৎক্ষণাৎ তাকে মুক্তির আদেশ দিলেন।

বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল
এসো এবার এই বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল জেনে নিইঃ

নাম- আবু রৈহান মুহম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনী।
জন্ম- ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু- ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দে।
বাসস্থান- আল বিরুনীতে।

শিক্ষা জীবন- আল বিরুনী আবু নাসের ইবনে আলি ইবন ইরাক জিলানি এবং তদ্রূপ
আরো কিছু বিদ্বান ব্যক্তির কাছে গণিতশাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন।
অধ্যয়নকালেই তিনি তার কিছু প্রাথমিক রচনা প্রকাশ করেন এবং প্রখ্যাত
দার্শনিক ও চিকিৎসা শাস্ত্র ইবন সিনার সাথে পত্র বিনিময় করেন। আল বিরুনির
মাতৃভাষা ছিল খাওয়ারিজিম আঞ্চলিক ইরানি ভাষা। কিন্তু তিনি তার রচনাবলি
আরবিতে লিখে গেছেন। আরবি ভাষায় তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি আরবিতে কিছু
কবিতাও রচনা করেন। অবশ্য শেষের দিকে কিছু গ্রন্থ ফার্সিতে অথবা আরবি ও
ফার্সি উভয় ভাষাতেই রচনা করেন। তিনি গ্রিক ভাষাও জানতেন। হিব্রু ও সিরীয়
ভাষাতেও তার জ্ঞান ছিল। গণিতবিদ আবু নাসের মানসুর ইবনে আলি ও চিকিৎসক আবুল
খায়ের আল-হুসায়ন ইবনে বাবা আল-খাম্মার আল-বাগ দাদদির সাথে গজনি চলে যান।
এখানেই তার জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। তখন হতে তিনি গাজনি শাহী
দরবারে সম্ভবত রাজ জ্যোতির্বিদ হিসেবে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি কয়েকবার
সুলতান মাহমুদের সাথে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গমন করে ছিলেন। আল বিরুনী সেখানে
প্রায় ১২ বছর অবস্থান করেছিলেন। এখানে সংস্কৃত ভাষা, হিন্দু ধর্ম, ভারতীয়
সভ্যতা ও সংস্কৃতি, দেশাচার, সামাজিক প্রথা, রাতিনীতি, কুসংস্কার ইত্যাদি
বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন।

ঐতিহাসিক বর্ণনাকারীদের মতে, তাঁর পাশাপাশি সে সময়ে কেউ ছিলেন না।
প্রাচীন জাতিদের বিষয়ে তিনি লিখেছেন ‘কিতাব আল-আথার আল-বাকিয়া অনি ল-করুন
আল-খালিয়া’। তৎকালীন ভারতবর্ষ বিষয়ে তাঁর বহু আলোচিত গ্রন্থ ‘তারিখ
আল-হিন্দ’ রয়েছে। আর বিজ্ঞান-চিন্তা ও গবেষণার ফলাফল তিনি ‘আল-কানুন
আল-মাসুদি’ নামক বইতে লিখে রেখেছেন।

গণিতের জগতে তাঁর ত্রিকোণমিতি ভাবনাই সবচেয়ে মৌলিক। ০০ থেকে ৯০০ পর্যন্ত
প্রতি 15’ পরপর বিভিন্ন কোণের সাইন মান বের করে একটা সাইন-সারণি
সাজিয়েছিলেন। ট্যানজেন্ট সারণিও তিনিই তৈরি করেছিলেন।

আল বেরুনী মোট আঠারটি বিভিন্ন মূল্যবান পাথর ও ধাতুর আপেক্ষিক গুরুত্ব
নির্ণয় করেছিলেন। আর এই মানগুলো ছিল নির্ভুল। তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে খনিজ
সংগ্রহ করে তাদের বাহ্যিক ধর্ম, বাণিজ্যিক মূল্য ও ব্যবহারিক সম্ভাবনা
যাচাই করেন। পৃথিবীর আকার নিয়েও তিনি ভেবেছিলেন। প্রসবণের উৎপত্তি,
নদী-নালা-খালের জলপ্রবাহ এসব বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যামূলক কথা লিখেছেন।


অন্যতম অবদানসমূহ :

১.    গণিতের জগতে ত্রিকোণমিতি ভাবনা যেমন ০০ থেকে ৯০০ পর্যন্ত প্রতি ১৫
পরপর বিভিন্ন কোণের বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত ৩ ১০/৭১  ও ৩ ১/৭ এর
মধ্যে অবস্থিত।
২.    এছাড়া ট্যানজেন্ট সারণিও তিনিই তৈরি করেন।

ভেষজ নিয়ে তাঁর বইয়ের নাম ‘কিতাব-ই-সায়দানা’। মধ্যযুগে এই বইয়ের ব্যাপক
খ্যাতি ছিল। আল বিরুনীর জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অপরিসীম। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড
শাকাও আল বিরুনী সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘Al-Biruni was the greatest
intellect that ever lived on this earth.’| তিনি ছিলেন গণিতজ্ঞ,
জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসাশাস্ত্র বিশারদ, ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক।

– সাদ আব্দুল ওয়ালী, প্রকাশিতব্য ছোটদের বিজ্ঞান মনীষা থেকে নেওয়া।

Leave a comment